রাজবাড়ী জেলার উত্তর দিকে প্রমত্তা পদ্মা নদী হাবাসপুর-সেনগ্রাম-ধাওয়াপাড়া ঘাট পর্যন্ত সরলভাবে প্রবাহিত হয়ে রাজবাড়ী জেলা শহরের কিঞ্চিৎ পশ্চিম হতে উত্তরে বাঁক নিয়ে দৌলতদিয়া পর্যন্ত প্রবাহিত । দৌলতদিয়ার সামান্য উত্তরে আরিচার ভাটিতে পদ্মা যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে । পদ্মার অপর পারে পাবনা ও মানিকগঞ্জ জেলা । দক্ষিণে পদ্মার শাখা গড়াই নদী । গড়াইয়ের ওপারে ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলা । এ জেলার পূর্বে ফরিদপুর ও পশ্চিমে কুষ্টিয়া জেলা । পশ্চিমে পাংশা উপজেলার শেষ প্রান্ত গফুগ্রাম থেকে ১৫ কিঃমিঃ দুরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহাসিক কুঠিবাড়ী কুষ্টিয়ার শিলাইদহ । জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রাচীন নদী হড়াই, চত্রা ও চন্দনা মৃত প্রায় ।
জেলার নাতিশীতোষ আবহাওয়ায় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৩ ডিগ্রি এবং সর্বনিম্ন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস । বৃষ্টিপাত ২২.২৪ থেকে ৩৭.৭৭ মিঃমিঃ । বাতাসের আদ্রতা ৭৫ শতাংশ । ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে রাজবাড়ী জেলার রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা । ফকীর সন্ন্যাস আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, মুজাহিদ আন্দোলন, ওহাবী আন্দোলন, ফরায়েজী আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহসহ বৃটিশ বিরোধী বহু আন্দোলন, কমিউনিস্ট আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ আন্দোলন, রেলশ্রমিক আন্দোলন এবং সর্বোপরি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজবাড়ীর ভূমিকা উল্লেখ করার মত । সাংস্কৃতিক অঙ্গণে উপ-মহাদেশ খ্যাত জলতরঙ্গ বাদক বামন দাস গুহের জন্মস্থান এই রাজবাড়ী । বিশ্বখ্যাত শিল্পী রশিদ চৌধুরীর জন্ম দিয়েছে এই জেলা । অমর কথা সাহিত্যিক বিষাদসিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন এর সমাধিও এ জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার পদমদীতে ছায়া সুনিবিড় সুশীতল পরিবেশে অবস্থিত । এ ছাড়া বহু কীর্তিমান রাজনীতিবিদ ও আমলার পূণ্য জন্মভূমি এই রাজবাড়ী । ক্রীড়াঙ্গণেও রয়েছে এ জেলার গৌরবময় অতীত । বর্তমানেও এ জেলার ছেলেমেয়েরা বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের সাঁতার, এ্যাথলেটিকস,ভলিবল, ফুটবল, ক্রিকেট প্রভৃতি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে বিজয়ী হয়ে জেলার সম্মান বৃদ্ধি করেছে । সাঁতারে রাজবাড়ীর মেয়েরা জাতীয় পরিমন্ডল পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছে ।
১,০৯২.২৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ জেলার জনসংখ্যা ৯,৫২,২৮০ জন । জনসংখ্যার ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম । দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায় সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু । এ ছাড়া খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীরাও এ জেলায় বসবাস করে । জেলার মানুষ ধর্মপ্রাণ হলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী । অধিকাংশ মানুষ কৃষি নির্ভর । যুগের বিবর্তন ও সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের জীবিকার ব্যাপক পরিবর্তন হলেও আজও এ অঞ্চলের মানুষ কৃষির উপর নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি । শতকরা ১০ ভাগ স্বচ্ছল এবং শতকরা ২০ ভাগ মধ্যবিত্ত । সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এ জেলায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু শিল্প-কল-কারখানা গড়ে উঠলেও তা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি । বৃহৎ শিল্পের মধ্যে গোয়ালন্দ টেক্সটাইল মিল নামে একটি সুতাকল, রাজবাড়ী জুট মিল, সুনিপূন অর্গানিক্স নামে একটি রেক্টিফাইড স্পিরিট প্রস্তুতকারী কারখানা অন্যতম । এ ছাড়া শিল্পনগরী বিসিক এর অধীনে বেশ কিছু ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা রয়েছে । মূলতঃ কৃষি নির্ভর হলেও চাকুরী, ব্যবসা, দিনমজুরি করা এ জেলার মানুষের অন্যতম পেশা । কামার, কুমার, তাতী, জেলে ও হরিজন প্রভৃতি পেশার লোকজনও এ জেলায় বসবাস করে । কিছুসংখ্যক অবাঙ্গালী পরিবারও এ জেলায় বসবাস করে ।
রাজবাড়ী জেলার অভ্যন্তরীণ ও বহিরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের জন্য সড়ক, রেলপথ ও নৌ-পথ রয়েছে । দৌলতদিয়া হতে ফরিদপুরগামী মহাসড়কের মাধ্যমে বরিশাল, যশোর, খুলনা তথা দক্ষিণাঞ্চলে এবং রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া মহাসড়কের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের সাথে সড়কপথে যোগাযোগের ব্যবস্থা রয়েছে । রাজবাড়ী হতে রেলপথেও খুলনা,রাজশাহী, রংপুর তথা উত্তরবঙ্গের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা রয়েছে । এই রেলপথে প্রতিদিন স্থানীয় এবং আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে । নৌপথেও রাজবাড়ী হতে পার্শ্ববর্তী জেলায় যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে । দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া-আরিচা, দৌলতদিয়া-নটাখোলা রুটে মানিকগঞ্জ, ঢাকা,ফরিদপুর ও তৎপার্শ্ববর্তী জেলা এবং জৌকুড়া ধাওয়াপাড়া-নাজিরগঞ্জ রুটে লঞ্চ ও ফেরী পারাপারের মাধ্যমে পাবনা তথা উত্তরবঙ্গের সংগে যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে ।